আমার দাদাভাই

দাদাভাই

আমার দাদাভাই

আমরা এখন একই ভবনে থাকি। তবে আব্বু-আম্মু আর আমরা থাকি ভিন্ন ভিন্ন ফ্ল্যাটে। আব্বু যখন বাসায় ফিরেন, তখন আমার ফ্ল্যাটে প্রথম ঢুকেন। তারপর আমার মেয়েটাকে অনেক সময় ধরে আদর করেন। মাথায় হাত বুলিয়ে দোয়া করে দেন। যাওয়ার সময় বলেন, দাদুভাই, যাই।

দাদুভাই শুনলেই ভিতরটা মোচর মেরে ওঠে। আব্বু যখন ছোট ছিলেন তখনই নাকি আমার দাদা-দাদি মারা যান। আব্বুকে যখন দেখি আমার মেয়েটাকে আদর করতে, তখন খুব আফসুস হয়। আমার দাদা-দাদি থাকলে না জানি কতটা আদর করতেন!

দাদা-দাদির জন্য মনটা হাহাকার করে। দাদা-দাদিকে না পেলেও তাদের স্মৃতিগুলো পেতে ইচ্ছা করে খুব।

বাগানের গাছগুলো নাকি দাদা নিজের হাতে লাগিয়েছিলেন। গ্রামে গেলে বাগানেই ভালো লাগে বেশী। ভাবি, দাদা বুঝি এখানেই দাঁড়িয়ে থাকতেন এক সময়। ভাবতেন গাছগুলো কখন বড় হবে। আজ গাছগুলো বড় হয়েছে কিন্তু দাদা সেখানে নেই।

দাদির স্মৃতিগুলোও খোঁজার চেষ্টা করি। বেশী কিছু জানতে পারি না। এক ধন্যাট্য ব্যবসায়ীর কন্যা ছিলেন। শেষ বয়সে অজানা এক রোগে ভুগে মারা গিয়েছিলেন। এটুকুই জানি। এর বেশী কিছু জানার সুযোগ হয়নি।

অবশ্য দাদার জীবনের ঘটনা জানার সুযোগ হয়েছিল অনেক। বেশিরভাগই কারামত টাইপের। যারা বলেন বড় বড় চোখ করে বলেন। একটা মূলনীতি আছে আমার কারামতের বিষয়ে। ‘নবী-রাসূল ছাড়াও আল্লাহ ওয়ালা ব্যক্তিদের জীবনে অলৌকিক কিছু ঘটতে পারে যেটা কারামত নামে পরিচিত। কারামতের অস্তিত্ব স্বীকার করি কিন্তু কারামতের বর্ণনা পছন্দ করি না। নির্দিষ্ট ব্যক্তির নামে যখন কারামতের ঘটনা শুনি, সেটা বিশ্বাসও করি না আবার অবিশ্বাসও করি না।” তাই দাদার নামে যখন কেউ কারামতের ঘটনা বলে, সযতনে এড়িয়ে যাই সেটা। তবে অন্যান্য ঘটনা শুনতে বেশ ভালো লাগে। ঘটনাগুলো মিলানোর চেষ্টা করি নিজের জীবনের সাথে।

দাদা নাকি বেশ লজ্জা পেতেন। একবার চোর এসেছিল বাড়িতে। অনেক কিছু চুরি হয়। দাদা অনেক টেনশনে পড়ে যান। না, চুরি হওয়া জিনিসের জন্য তার টেনশন ছিল না। তিনি ভাবতেন চোর তাকে কোন অবস্থায় জানি দেখে ফেলেছে? সেই লজ্জাটাই বোধহয় বংশানুক্রমে পেয়েছি আমি। তাই রাতে যখন প্রচণ্ড ইচ্ছে করে জানালা খুলে ঘুমাতে, সেই চোরের ভয়েই আর খোলা হয় না জানালা।

শুনেছিলাম, দাদা দেওবন্দে পড়েছিলেন। বাড়িতে যখন আসেন, কারী ইব্রাহীম রহঃ তাকে উজানি মাদরাসার প্রিন্সিপালের দায়িত্ব নিতে বলেন। কিন্তু বড় দায়িত্ব নিতে ভয় পান। যেমনটা আমিও ভয় পাই বড় কোন পদের দায়িত্ব নিতে। দাদা চলে যান তার নানার বাড়ি। কিন্তু শান্তি পাচ্ছিলেন না। একদিকে বাবার মনে কষ্ট দেওয়া আবার অপরদিকে দায়িত্ব পালনে ভুল-ত্রুটির ভয়। এভাবে একটা অস্থির সময় পার করে ফিরে আসেন তাঁর বাবার কাছে। মাফ চান। মেনে নিন যেই আদেশ তাকে দেওয়া হয়েছিল। আমৃত্যু উজানি মাদরাসার প্রিন্সিপ্যাল ছিলেন তিনি। প্রায় দুই যুগ বা আড়াই যুগ।

দাদার যেই ঘটনা সবচেয়ে ভালো বেশি লাগে সেটা হল, তিনি নির্লোভ ছিলেন। কওমি মাদরাসাগুলো চলে কওমের টাকায়। শুধুমাত্র মানুষ থেকে কালেকশন করেই একসময় চালানো হত মাদরাসাগুলো। তো একবার দাদা একগ্রামে গেলেন উজানি মাদরাসার জন্য টাকা কালেকশন করতে। গ্রামবাসী মহাভক্ত ছিল কারী ইব্রাহীম রহঃ- এর। তাঁর ছেলে এসেছে। সবাই অনেক খুশি হয়েছিল। তারা দাদাকে বললেন বসতে। গ্রামবাসী নিজেরাই কালেকশন করতে নেমে পড়লেন। দাদার সামনে তৎকালীন পয়সার দুইটা থলি এনে রাখা হল। দাদা বললেন, থলি দুইটা কেন? গ্রামবাসী বলল, আপনি এত কষ্ট করে আমাদের গ্রামে এসেছেন। তাই একটা থলি মাদরাসার জন্য আর একটা আপনার জন্য হাদিয়া। দাদা বললেন, ইন্নালিল্লাহ! আমি তো নিজের জন্য এখানে আসিনি। এসেছি মাদরাসার গরীব ছাত্রদের জন্য সহায়তা নিতে। এটা বলে তিনি দুই থলিকে একসাথে মিশিয়ে ফেলেন এবং পুরোটা মাদরাসার ফাণ্ডে দিয়ে দেন।

আগে তো মানুষ কুপি ব্যবহার করত। দাদা নাকি দুইটা কুপি রাখতেন কাছে। কেউ যখন আসত তখন জানতে চাইতেন কেন এসেছে? যদি দাদার কোনো কাজে আসা হত তাহলে কুপিটা নিভিয়ে ফেলে অন্য কুপি জ্বালাতেন। মাদরাসার কুপি নিজের কাজে ব্যবহার করা পছন্দ করতেন না তিনি।

আব্বু যখন ঘটনাগুলো বলেন, গর্ব আর আনন্দে ভরে যায় আব্বুর মুখ। গর্ব লাগে আমারও। কারামতের ঘটনা শুনতে চাই না। কিন্তু লোভ থেকে বেঁচে থাকাই তো আমার কাছে মনে হয় সবচেয়ে বড় কারামত। তবে দাদা যে বৈরাগীদের মত ছিলেন, তেমন না। কারী ইব্রাহীম রহঃ ছিলেন জমিদার বংশের। কিন্তু যেভাবে বর্ণনায় পাই তিনি দ্বীনের জন্য জমিদারী ত্যাগ করেছিলেন। তবে জমিদারী ত্যাগ করে নোয়াখালী ছেড়ে চাঁদপুর আসলেও ওয়ারিস হিসেবে বিপুল সম্পত্তির মালিক হয়েছিলেন। নিজের এগারো ছেলের মাঝে খুব সুন্দরভাবে সম্পত্তি বণ্টন করেছিলেন তিনি। প্রতি ছেলেকে একটা করে পুকুর, বড় বাগান আর কয়েকটি করে ক্ষেত-খামার দিয়ে গিয়েছিলেন। বাড়িগুলোও এমনভাবে তৈরি যে পর্দা নষ্ট হওয়ার কোন ভয় নেই। দাদা সেই সম্পদের পরিচর্যা করেছিলেন। বাগান-ক্ষেতের মাধ্যমে সম্পদ উপার্জন করে যমীনের পরিমাণ বাড়ানো। বাগানে অর্থ বেশী আসবে এমন গাছ লাগিয়ে যাওয়া। দাদা তো আমাদের কথা ভেবেই কাজগুলো করেছিলেন। এখন আমরা যেই ফলগুলো ভোগ করছি।দ্বীনদার হলেই যে গরীব হতে এমন তো নয়। হালাল পথে উপার্জনের তাগিদ এসেছে কোরআন হাদিসেই। দাদা হয়ত চেয়েছিলেন আমরা যেন দারিদ্রতার কষ্ট না পাই। দারিদ্রতা মানুষকে কুফরের দিকে টেনে নেয়।

শুনেছিলাম দাদা নাকি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে মারা যান। মরার পর এমন কিছু প্রমাণ পাওয়া যায় যাতে বুঝা যায়, তাকে যাদু করা হয়েছে। বিষয়টা কেমন যেন লাগে আমার। আসলেই কি যাদু করে কাউকে মারা যায়?

আমি নাকি ছোটবেলায় দাদা-দাদির জন্য খুব কান্না করতাম। দেশে গেলেই বলতাম, দাদা-দাদি কই? আম্মু বলতেন, কবরে। আমি নাকি কবরাস্থানে যেতে চাইতাম। বলতাম, কবরে কেন? আমি গিয়ে তাদেরকে কবর থেকে নিয়ে আসব।

আব্বুকে মাঝে মাঝে বলি, দাদাকে কাছে পেয়েছেন এমন কেউ জীবিত আছেন? আব্বু বলেন, আছেন। উনি উনি উনি …। বলি, একদিন তাদের কাছে নিয়ে যাবেন।কিন্তু আব্বুর আর সময় হয় না কারো কাছে নিয়ে যাওয়ার। হয়ত সময় হয়না আমারও। অথচ আমার প্রবল ইচ্ছা দাদার জীবন সম্পর্কে জানার। দাদাকে জীবিত পাইনি যে তাঁর স্মৃতি থাকবে আমাদের মনে। কিন্তু দাদার স্মৃতি যে অন্তরে ধারণ করতে চাই। তাই কারো থেকে ঘটনা শুনে বা লেখার মাধ্যমেই নাহয় সেই স্মৃতি সংরক্ষিত থাকুক।

৭/৪/২০১৮

Facebook Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back To Top
error: Content is protected !!