আমরা যে যতটুকুই পড়াশুনা করেছি, সব কী আমরা আমাদের জীবনে কাজে লাগাতে পেরেছি?
যেমন উপপাদ্য-সম্পাদ্য, ত্রিকোণমিতি, কৃষিশিক্ষা কিংবা বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় সাবজেক্টের মধ্যে আমরা যেই বিষয়গুলো পড়েছি।
অথবা মাদ্রাসার ক্ষেত্রেও এই যে প্রাচীন কালের যুক্তিবিদ্যার কিতাবগুলো পড়ছি।
এরকম প্রায় সমস্ত বিষয় নিয়ে প্রশ্ন করা যায় যে, এগুলো শিখে জীবনে কাজে লাগাতে পারলাম তো?
যারা শিক্ষকতা পেশার সাথে জড়িত তাদেরকে আপাতত আমাদের হিসেবের বাহিরে রাখি। কারণ, কাজে লাগানো বলতে আমি অন্যকে শেখানোর কথা বলছি না। কাজে লাগানো বলতে বুঝাচ্ছি এর ব্যবহারিক প্রয়োগ ঘটানোর কথা।
কিছু মানুষের কাজে যে লাগছে না তা বলব না। তবে যা শিখছেন তা কাজে লাগাতে পারছেন এমন মানুষের সংখ্যা হয়ত শতকরা ৫ থেকে ১০ ভাগ হবে।
কিছু বিষয় আমাদের শিখতেই হবে।
একজন মুসলমান হিসেবে আমাদের যেগুলো জানা প্রয়োজন। যেমন, (আকাইদ) বিশ্বাসের সাথে সম্পর্কিত প্রাথমিক ধারণা, নামায পড়ার জন্য প্রয়োজনীয় পাক-পবিত্রতার সম্পর্কিত মাসালা, কোরআন তিলাওয়াত শুদ্ধ করা ইত্যাদি।
এর বাহিরে সমাজে চলার জন্য আমাদের আরও কিছু জানা প্রয়োজন। যেমন বাংলা লিখতে ও পড়তে পারা, যোগ, বিয়োগ, গুণ, ভাগ ইত্যাদি করতে পারা।
প্রতিটি মানুষেরই দৈনন্দিন জীবনে কাজ করতে গিয়ে কিছু বিষয় জানার প্রয়োজন পড়ে। সেই বিষয়গুলোকে আমরা প্রয়োজনীয় বিষয় বলতে পারি। আর এর বাহিরের বিষয়গুলোকে বলতে পারি অতিরিক্ত।
আমাদের যে কাজটি করতে হবে তা হল, এই প্রয়োজনীয় বিষয়গুলোকে সবার জন্য সহজবোধ্য করতে হবে, সহজলভ্য করতে হবে। দেশের প্রতিটি নাগরিকের জন্য এই প্রয়োজনীয় শিক্ষাকে নিশ্চিত করতে হবে।
আমাদের মানসিকতায় একটি বড় ভুল রয়ে গেছে। শারিরিক পরিশ্রমের কাজগুলোকে আমরা ছোট চোখে দেখি। চাকরের মত পরিশ্রম করেও চাকরী করাকে আমরা অসম্মানজনক ভাবি না। আমরা ভাবি যে, যারা রিকশা চালায়, যারা সিএনজি চালায়, যারা কৃষিকাজ করে, এমনকি অনেকক্ষেত্রে যারা এলাকায় ছোট খাটো দোকানে বসে তারা যেন নিচু শ্রেণীর। তাই আমরা হন্য হয়ে যাই কারো গোলামি করার জন্য। চাকরী করার জন্য। সতের বছর লাগিয়ে সার্টিফিকেট বাগিয়ে জুতার তলা খসিয়ে একটি চাকরী যদি পাই তাহলেই যেন জীবনটা সফল। এই সময়ে আমাদের স্বপ্ন হারিয়ে যাক, জীবন বিষিয়ে যাক, তাতে যেন পরোয়া করার কিছু নেই। চাকরী করলে মাসে বেতন পাব বিশ হাজার। আর সিএনজি কিনে চালাল পাব ত্রিশ হাজার। নাহ্, তারপরেও আমি সিএনজি চালাতে পারব না। তাহলে আমার পরিবার সমাজে কিভাবে মুখ দেখাবে? সমাজ কী বলবে? যদি সমাজের লোকেরা কখনো আমার পরিবারের বায়নাগুলো পূরণ করবে না।
তাহলে কেন আমরা এইম ইন লাইফ রচনায় শুধু ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ক্রিকেটার আর টিচার হওয়ার কথা ভাবছি। এর বাহিরে কি সমাজে কোন পেশা নেই? অন্য কোন পেশার প্রয়োজন নেই?
আমাদের এই মানসিকতা প্রথম ঠিক করতে হবে। এইম ইন লাইফ রচনায় লেখা গরীবের সেবা করতে চাওয়া ডাক্তার বা কল্পনায় কোটিপতি ইঞ্জিনিয়ারের বাহিরেও আরও অনেক পেশা আছে জগতে। যেই পেশাগুলো সমাজের প্রয়োজনেই তৈরি হয়েছে। তাই সমাজে কোন পেশাকে অসম্মানের মনে করার সুযোগ নেই। অসম্মান তো অসৎ ব্যক্তিদের জন্য যারা নিজ নিজ পেশায় কাজের ক্ষেত্রে সততা বজায় রাখেন না।
একজন মহিলা সারাদিন শুধু কান্না করেন। তার ছেলেকে নিয়ে তার অনেক স্বপ্ন ছিল। কিন্তু ছেলের যে জীবন শেষ হয়ে গেল।
কিন্তু কী এমন ঘটেছে যে ভাবছেন জীবন শেষ? ছেলেটাকে আমিও চিনি। ভদ্র। পরিবারের যে কোন কাজে সবার আগে দৌড়ে যায় না। কিন্তু পড়াশুনা তাকে আর আকর্ষণ করে না। এ যেন এক ভীষণ ক্লান্তিকর পথ। এরকম হাজারো ঘটনার স্বাক্ষি হয়ত আপনারাও।
যদি এ প্লাস না পায় তাহলে কী জীবন শেষ? বা ফেলই করলো মনে করেন?
এমন কোন মানুষ কি নেই যিনি খুব উঁচু পদে যাননি, অনেক টাকা কামাননি কিন্তু ব্যক্তিজীবনে খুব সুখী?
কৃষিশিক্ষা নামে একটি সাবজেক্ট রয়েছে আমাদের সিলেবাসে। আমি ভেবে পাই না যে আমাদের সন্তানদের এটা কেন পড়তে হবে? অমুক রাজার তমুক যুদ্ধের ঘটনা জেনে আমাদের কী লাভ? কোন সাহিত্যক কোন এলাকায় কোন সালে জন্মগ্রহণ করেছেন তা জেনে কি সত্যিই আমাদের কোন লাভ আছে?
আমি বলতে চাচ্ছি না, অলাভজনক কিছু পড়ার কোন দরকার নাই। আমি বলতে চাচ্ছি যে, অলাভজনক এই বিষয়গুলো আমরা আমাদের সিলেবাসে রেখে আমাদের সন্তানদের মানসিক প্রেসার দিতে পারি না।
যার কৃষিতে আগ্রহ তার জন্য কৃষিকাজের সাথে জড়িত বিষয় জানার সুযোগ থাকবে। এর জন্য তার শিক্ষাব্যবস্থা ভিন্ন হবে। যার ইতিহাসে আগ্রহ তার জন্য ব্যবস্থা ভিন্ন হবে। যার সাহিত্যে আগ্রহ তার জন্য ব্যবস্থা ভিন্ন হবে। এভাবে সাজানো হবে শিক্ষাব্যবস্থা।
এমন হবে না যে, একজন খুব ভালো গণিত বোঝে কিন্তু বাংলা সাহিত্যিকদের নাম মনে রাখতে পারায় সে গণিতে পড়ার সুযোগ পায়নি। ইংরেজিতে ভালো না করায় ইতিহাস নিয়ে পড়ার সুযোগ পায়নি।
বরং শিক্ষাকে আমাদের বইয়ের বাহিরে নিয়ে আসতে হবে। রাঁধুনিদের জন্য হাতেকলমে রান্না শিক্ষা, দর্জিদের জন্য সেলাই শিক্ষা। এমনকি রাজমিস্ত্রির জন্যও শিক্ষার ব্যবস্থা থাকবে যে সে কিভাবে তার কাজকে সুন্দর করে করতে পারে।
একটি শিক্ষাব্যবস্থার স্বপ্ন দেখি।যেখানে শিশুদের উপর প্রত্যাশার চাপ নেই। বইয়ের ভারে যাদের পিঠ নিচু হয়ে যায় না। কাউকে এমন কিছু শিখতে হয় না যে জিনিস জীবনে তার কাজে আসবে না। আবার সবারই সুযোগ রয়েছে নিজের মনের মত কোন বিষয় শেখার।যেখানে সার্টিফিকেটের নামে কাগজ বিক্রি হয় না। যোগ্যতায় চাকরী হয় কিন্তু চাকরী লাভের জন্যই কেউ শিক্ষা গ্রহণ করে না। বেকার থাকার চেয়ে মাটি কাটাকে যে শিক্ষালাভকারিরা ভালো মনে করে। সবাই শিক্ষালাভ করে আনন্দ নিয়ে। যার যেটা ভালো লাগে, যার যেটা প্রয়োজন।
এমন শিক্ষাব্যবস্থা কি কখনো সম্ভব?
জানি না।
তবে এটা জানি,
স্বপ্ন থেকেই বাস্তব।
স্বপ্ন থেকে হয় সব।
Facebook Comments