দাদীর ভাই একবার এসেছিলেন বাসায়। আম্মু নানানরকম খাবার বানিয়ে তার সামনে পাঠালেন আমাকে। তিনি বললেন, মা, আমার তো এই খাবারের চাহিদা নেই। যে কোন খাবার যখন চাই চাকররা এসে হাজির করে দেয়। কিন্তু যেটা চাই সেটা যে পাই না।
প্রথমে বুঝিনি কী চান তিনি? দুইটা দিন বাসায় ছিলেন। সারাদিন কথা বললেন। তার কথা বলার আগ্রহ দেখে আমি বই হাতে নিলেও পড়তে পারিনি। কারণ, দেখছিলাম উনি কথা বলতে না পারলে উনার মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে। পরীক্ষায় ভালো নাম্বার পাওয়ার চেয়ে একটা মুখের হাসি আমার কাছে অনেক বেশি দামী।
যাওয়ার দিন ছেলে উনার ছেলে মানে আব্বুর মামাতো ভাই গাড়ি পাঠিয়ে দিল। কাঁদতে কাঁদতে গেলেন। বললেন, এই দুইটা দিনে আমার ভিতর থেকে কয়েক পাহাড়ের সমান বোঝা যেন নেমে গেল।
উনার ছেলে বড় কোন পদে চাকরী করেন। অনেক বড় চাকরী। অনেক ব্যস্ততা। যৌবনে ব্যস্ততা থাকা দোষের না। যৌবনটাই তো কাজের সময়। কিন্তু ব্যস্ততার কারণে তিনি খুব একটা সময় দিতে পারেন না পিতাকে। অথচ পিতার মন ছটফট করে আপনজনদের সাথে কথা বলতে।
ছেলের ঘরের একটি নাতিও ছিল। কিন্তু অদ্ভুত বাস্তবতায় সেও ব্যস্ত হয়ে গেছে। ছোট একটা বাচ্ছা সেও ব্যস্ত এ শহরে। স্কুল, কোচিং, প্রাইভেট, আর্ট শেখা। কতকিছু যে শিখতে হয় তার। এত কিছু শিখে খেলার বা খোলা আকাশই দেখার সময় হয় না তার। দাদুর সাথে কথা বলা তো পরের বিষয়।
তাই দাদুর সব থাকে। টাকা-পয়সা। চাকর-বাকর। প্রয়োজন অতিরিক্ত খাবার। শুধু থাকে না একটা প্রিয় মানুষ। যার সাথে কথা বলে তিনি মনটা হালকা করবেন।
উনি চলে যাওয়ার পরেই নিয়ত করেছিলাম তার কাছে একদিন যাব। আবার হালকা করে দিয়ে আসব মনটাকে।কিন্তু তার পূর্বেই শুনলাম উনার মৃত্যু সংবাদ।
এখান থেকে যাওয়ার পরেই উনি বাসায় থাকতে পারছিলেন না। বলছিলেন, উনার এ শহরে থাকতে ভালো লাগে না। উনি গ্রামে চলে যাবেন। ছেলেরা অনেক বুঝালেও রাখতে পারেনি উনাকে। গ্রামে চলে গেলেন। গ্রামে গিয়ে উনি একটা গরু কিনলেন। গরু পালবেন। কে জানে হয়ত গরুর সাথে কথা বলেই নিজেকে হালকা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু একদিন গ্রামের লোকেরা লক্ষ্য করলো, তিনি ঘর থেকে বের হচ্ছেন না। গ্রামের লোক বলেই হয়ত লক্ষ্য করেছেন। বিছানার পাশে মাটিতে পড়েছিল তার নিথর দেহটা।
Facebook Comments