(২০২০ সালের আগস্ট মাসে লিখেছিলাম এই লেখাটি। খুব খারাপ সময় যাচ্ছিল তখন)
ব্যক্তিজীবনে বড় কিছু হওয়ার ইচ্ছা কখনোই ছিল না। শুধু মাথার উপর একটা ছাদ থাকবে, খাওয়ার টাকাটা হাতে থাকবে আর সারাটা জীবন পরিবারের কাছাকাছি থাকত পারব, এটাই ছিল চাওয়া।
তাই এতদিন নিজেকে নিয়ে কোন চিন্তাও করিনি। সুযোগ পেলেই নতুন কোন বিষয় শেখার চেষ্টা করেছি। যেগুলো শিখেছি, তা শেখানোর চেষ্টা করেছি। আর পরিবারের পাশে থাকার চেষ্টা করেছি, যার যতটুকু কাজে সাহায্য করা যায়।
আমাকে অনেকেই বলে, আমি আমার মেধা নষ্ট করেছি। আমার সামনে অনেক বড় সুযোগ ছিল বড় হওয়ার। আমি সেই সুযোগ হেলায় হারিয়েছি। শুনে কিছুক্ষণ মন খারাপ থাকে। তারপর নিজের সাথে যখন নিজে কথা বলি, তখন বুঝি, বড় হওয়ার নেশা আমাকে টানে না। টানে শুধু এমন কিছু হওয়ার নেশা, যা হতে পারলে আমি অনেক মানুষের উপকারে আসতে পারব।
খোঁচাও যে কম খেয়েছি তা না। সেদিন এক সিনিয়র সহকর্মী বললেন, আপনি তো এ যুগের ওলী-আল্লাহ। খোঁচাটা প্রথমে বুঝিনি। পরে বুঝলাম, সেদিন আমার পরা পোষাকে ছেড়া ছিল।
মালিবাগে যখন পড়তাম, তখন নিচের জামাতের পরিচিত একজন এসে বললো, ভাই আপনি ইস্ত্রি করা জামা পড়েন না কেন? সম্ভবত এরকমও বলেছিল, আমার কুঁচকানো জামার কারণে মালিবাগের ছাত্রদের সম্মানহানি হয়।
তবু আমি এমনই থাকি। নিজের মতো। শুধু এটা মাথায় রাখি, পোশাক নিয়ে চিন্তার কিছু নেই। যারা আমাকে চিনে, তারা তো জানেই আমি কে আর কেমন। আর যারা চিনে না, তাদের ভাবনায় আমার কী-ই-বা আসে যায়।
এমনি চলছিল আমার জীবন। কিছুটা ছন্নছাড়া। কিছুটা বাঁধনহারা। বেপরোয়া নই, তবে পরোয়াও করিনি কাউকে। পরামর্শ নিয়েছি, তবে তার আগে শুনেছি নিজের মনের কথা। চাকরীর অধিনস্থতা মানতে পারব না, তাই সার্টিফিকেট আমার কাছে গুরুত্বহীন। মাঝপথে এসে ছেড়ে দিয়েছিলাম সিএসই-র পড়াশুনা। কয়েকটি প্রোগ্রামিং ল্যাংগুয়েজ শিখেছি, এসইও শিখেছি, কম্পিউটার জগত সম্পর্কে আরো ভালোভাবে জেনেছি। এটাই অনেক, সার্টিফিকেটের কী দরকার?
এখনো যে, একস্থানে পড়াই, সেটাকে চাকরী ভাবি না। ভাবি, কিছু জিনিস তো খুব কষ্ট করে শিখলাম, দেখি, সহজে শেখাতে পারি কিনা? কোন পেশায় যাব তাহলে? ব্যবসা? সেটাও তো মনে টানেনি। ব্যবসার সাথে মুনাফা-লাভের সম্পর্ক। কিন্তু আমার তো মুনাফা নেওয়াটাকেই কেমন যেন লাগে। যদিও এটা দোষের কিছু না। কিন্তু আমার তো মনে চায়, মুনাফা না নিতে। শুধু মুনাফা না, বহন করে যে আনলাম সেই ভাড়ার টাকাটাও না নিতে। একজনের উপকারে তো আসতে পারলাম, যথেষ্ট।
কিন্তু এভাবে তো পেট চলে না? কী করব? এটার উত্তরও স্পষ্ট ছিল নিজের কাছে। মনের স্বাধীনতা বজায় রেখে যে কাজ করা যাবে, সেটাই করব। রিকশা চালানো? হুম। কুলিগির? হুম। সমস্যা নেই। কাজ তো কাজই। যে কাজে নিজের মনের স্বাধীনতা হারিয়ে যায় বা অন্যের হক্ব নষ্ট হয়, শুধু সে কাজ না হলেই হল।
এভাবেই চলছিল জীবন। একদিন সুমাইয়াকে বললাম, দেখো আমরা কত ভালো আছি। তোমার পাশে আমি থাকতে পারছি। বাচ্চাদের মুখে হাসি দেখছি। আব্বুও আমার উপর খুশি আছেন। এই কথাগুলোই কি কাল হল আমার? নিজের ভাগ্যের উপর নিজের নযর লাগে?
তারপর দিন থেকে যে কী হল, তা ভাষায় বর্ণনার মতো না বা বর্ণিত হলেও তা অনুভব করা সম্ভব না।
আমার স্ত্রী অসুস্থ হয়ে গেল। আমি তাকে নিয়ে হাসপাতাল আর ডায়াগনস্টিক সেন্টারে দৌড়াই। ছোট মেয়েটা মাকে ছাড়া এক মুহূর্তও থাকতে পারে না। তাকে কান্নার মধ্যেই রেখে হাসপাতালে চলে যাই। তার কথা ভেবে আমারও কান্না আসে। বড় মেয়েটা বুঝে। তাই তাকে রেখে যাওয়া সম্ভব হয় না। তাকে কোলে নিয়ে হাটতে হাটতে আমার কাঁধ যেন ছিঁড়ে যায়। করোনার কারণে সরকারী হাসপাতালের চিকিৎসা বন্ধ। তাই বেসরকারী হাসপাতালেই যেতে হয়। আমার আর সুমাইয়ার জমানো যা ছিল, তা যেন নিমিষেই হারিয়ে যায়। আব্বুর কাছ থেকে টাকা নেই। তিনি নিঃসঙ্কোচে দেন। তবে সঙ্কোচ কি আমার কাটে? বুইড়া একটা ছেলে, বাচ্চা হইয়া গেছে, এখনো বউয়ের চিকিৎসা বাপের থেকে নেয়। না, কেউ আমাকে বলে না, আমি নিজেই নিজেকে বলি। অবশেষে ঋণগ্রস্থ হই, যেখানে সারাটা জীবন ঋণ গ্রহণ করাটাকে খারাপ চোখে দেখে এসেছিলাম। কিন্তু চিকিৎসাও তো হয় না। এর কাছে যাই, অনেকগুলো পরীক্ষা দেয়। ভালো হয় না। আবার আরেকজনের কাছে যাই, সেও পরীক্ষা দেয়। ভালো হয় না। পরের জন বলে, আগের জনের চিকিৎসা ভুল। এক হাসপাতালের রিপোর্ট আবার আরেক হাসপাতালের রিপোর্টের সাথে মিলে না।
কই যে যাব, কী যে করব, কিছুই মাথায় ধরে ন।মাঝেমাঝে মনে চায়, হারিয়ে যাই। সুইসাইড করব? সেটারও সাহস হয় না। মরণের কষ্ট না হয় সহ্য করলাম। আখেরাতে? না, এটা পারব না। আর কী করব? বেঁচে থেকে যদি হারিয়ে যাই, আবার ফিরে আসতে হবে বাচ্চা দুইটার টানে। টাকাও তো লাগবে অনেক। কারো সাহায্য নিব? প্রিয় কিছু মানুষ যেমন প্রস্তাব দিয়েছে। নাহ, সেটাও সম্ভব না। এরচেয়ে সুইসাইডও সহজ লাগে। বেশী টাকা পাওয়া যায় এমন কোন চাকরীর পিছে দৌড়াব? অথবা ব্যবসা? এর জন্য তো আমার মনের স্বাধীনতা হারিয়ে ফেলতে হবে অথবা মনটাকে অন্যরকমভাবে গড়ে তুলতে হবে।
কী করব আমি?
জানি না।
জানি শুধু এটাই, আমার অনেক কষ্ট হচ্ছে।
খুব কষ্ট হচ্ছে।
খুব।
(৫/৮/২০২০)
Facebook Comments