যে আন্দোলন দিল্লিতে আনলো বিরাট পরিবর্তন

আন্দোলন

যে আন্দোলন দিল্লিতে আনলো বিরাট পরিবর্তন

যন্তর মন্তর। নয়াদিল্লির একটি বিশেষ এলাকা। সারা বছরই যেখানে চলে আন্দোলন, চলে মিছিল-মিটিং, সমাবেশ। যেমন এক সময় এদেশে চলতো (ঐতিহাসিক) পল্টন ময়দানে বা এখনো কিছুটা চলে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে।

তবে দিল্লির এই যন্তর মন্তরে এক সময় দেখা হত গ্রহ-নক্ষত্রের পথচলা। নির্ণয় করা হত সময়। কিন্তু কে জানতো, এখানে শুরু হওয়া এক আন্দোলনের সূত্র ধরেই বদলে যাবে দিল্লির সামনের সময়।

এপ্রিল, ২০১১।

যন্তর মন্তরে শুরু হল অভাবনীয় এক আন্দোলন। আন্দোলনের নেতৃত্বে একটি পরিচিত মুখ-আন্না হাজারে আর আন্দোলনের পিছনে একটি সংগঠন – ইন্ডিয়া এগেইনস্ট করাপশন (আইএসি)।

আন্না হাজারে একজন প্রখ্যাত সমাজসেবী। বিভিন্ন সামাজিক কাজ ও আন্দোলনের কারণে যিনি পেয়েছেন ‘পদ্মভূষণ’ সম্মাননা। (পদ্মভূষণঃ ভারতের তৃতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা।) অপরদিকে আইএসি যেন একটি ছাতা। যার নিচে এসে জড়ো হয়েছেন বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ। ২৪ জনের কেন্দ্রীয় কমিটিতে রয়েছেন সাবেক মন্ত্রী, সুপ্রিম কোর্টের সাবেক বিচারপতি, সাবেক সরকারী অফিসার, দেওবন্দ পড়ুয়া মাওলানা, চার্চ বিশপ এবং বিভিন্ন অঞ্চলের অসংখ্য সমাজকর্মী।

যন্তর মন্তরে শুরু হওয়া এই আন্দোলনের মূল দাবী, সংসদে পাশ করতে হবে জনলোকপাল বিল।

লোকপাল। একটি সরকারী কিন্তু স্বাধীন সংস্থা। যাদের কাজ ক্ষমতাসীন নেতা ও সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দুর্নীতি নিয়ে তদন্ত করা। প্রমাণসাপেক্ষে যারা দুর্নীতিবাজদের বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করাতে পারে।

২০১৩ সালে আইন পাশের পর ২০১৯ সালে এসে যাত্রা শুরু করে এই সংস্থাটি। সদ্য শুরু হলেও এ সংস্থাটি গঠনের দাবী অনেক পুরনো। প্রায় প্রতিটি নির্বাচনের আগেই রাজনৈতিক দলগুলো প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল আইন পাশ করে লোকপাল গঠনের। কিন্তু ১৯৬৮ সালের পর থেকে মোট দশ দশবার আইনটি সংসদে পাশ করার চেষ্টা করা হলেও তা সম্ভব হয়নি। হয়নি না বলে চাওয়া হয়নি বললেই বোধহয় বেশী ভালো। কারণ, ক্ষমতাসীন রাজনীতিবিদরা কখনো চায়নি এমন আইন থাকুক, যেই আইনের ফলে তাদের দুর্নীতির পথ রুদ্ধ হয়ে যাবে।

২০১০ সাল। দশম বারের মতো সংসদে পেশ করা হল লোকপাল বিল। কিন্তু লোকপালের বিলের যে খসড়া, তা দেখে ক্ষুদ্ধ হয়ে ওঠলেন সুশীল সমাজ। বিশেষকরে সুশীল সমাজের সেই অংশটি, যারা দীর্ঘকাল যাবত দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে আসছেন। কারণ, প্রস্তাবিত খসড়া বিল অনুযায়ী লোকপাল হতো নখ-দন্তহীন বাঘের মতো। হতো দুর্নীতিবিরোধী এমন একটি প্রতিষ্ঠান, দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষমতা যাদের হাতে নেই। দুর্নীতির তদন্ত যারা স্বপ্রণোদিত হয়ে শুরু করতে পারবে না। নিতে হবে ক্ষমতাসীনদের অনুমতি। তারপর পুলিশ-সিবিআইকেও তারা নিজেদের অধীনে এনে কাজ করাতে পারবে না এবং পারবে না কোন দুর্নীতিবাজকে বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করাতে। দুর্নীতির প্রমাণ পেলে শুধুমাত্র বিচারকার্য শুরু করার সুপারিশ করতে পারবে তারা। আর দুর্নীতির বিচারও খুব কঠিন নয়। সর্বনিম্ন ছয় মাস আর সর্বোচ্চ সাত বছরের জেল।

দুর্নীতি বিরোধী আন্দলনকারীদের দীর্ঘদিনের প্রত্যাশিত একটি সংস্থা লোকপাল। এই সংস্থাকে ঘিরেই দুর্নীতিমুক্ত ভারতের স্বপ্ন দেখছিল তারা। কিন্তু এই সংস্থাকে যে এমন নখ-দন্তহীন বাঘ বানিয়ে রাখা হবে, সেটা কল্পনাও করেননি তারা এবং মেনেও নিলেন না। শুরু হল এক কঠিন দীর্ঘপথের যাত্রা।

তিনটি সিদ্ধান্ত নেওয়া হল।

১. দুর্নীতি বিরোধী লড়াইয়ে যারা সামনের কাতারে আছেন, সবাইকে এক ছাতার নিচে নিয়ে আসা।

২. সরকার প্রস্তাবিত লোকপাল বিলের খসড়ায় যে অসংগতিগুলো রয়েছে, সেগুলো তুলে ধরা এবং সরকারী খসড়া সংশোধন করে একটি সংশোধিত খসড়া তৈরি করা।

৩. সংশোধিত খসড়া অনুযায়ী যেন সংসদে লোকপাল বিল পাশ হয়, তা নিশ্চিত করার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করা।

এভাবে দুর্নীতি বিরোধী আন্দোলনের প্রথম সারির সবাইকে নিয়ে গঠিত হল একটি এনজিও- ইন্ডিয়া এগেইনস্ট করাপশন (IAC) এবং সন্তোষ হেগড়ে, অরবিন্দ কেজরিওয়াল ও প্রশান্ত ভূষণ মিলে তৈরি করলেন লোকপাল বিলের সংশোধিত খসড়া। তাদের তৈরিকৃত খসড়াটি ‘জন লোকপাল বিল’ নামে পরিচিতি পায়। IAC গঠন ও জন লোকপাল বিল তৈরি সহজ হলেও সংশোধিত এ বিলটি সংসদে পাশ করা সহজ ছিল না।

প্রায় চার মাস ধরে চালানো হল জন লোকপাল বিল পাশ করার দাবীতে প্রচারণা। বাইক র‍্যালি, সোশ্যাল মিডিয়া, প্রেস কনফারেন্স ইত্যাদি সকল উপায় ব্যবহার করা হল। দাবীও জানালো হল সরকারের কাছে, যেন সংসদে পাশ করা হয় জন লোকপাল বিল। তবে গুরুত্ব পেল না সেই দাবী। কারণ, IAC-এর সমর্থক তখনো কম ছিল। তাদের দাবীও তারা জনদাবীতে পরিণত করতে পারেনি।

কিন্তু হঠাৎ করেই পাল্টে গেল পরিস্থিতি। যন্তর মন্তরে যখন আন্না হাজারে আমরণ অনশন শুরু করলেন, সবার আগ্রহের কেন্দ্রে পরিণত হল জন লোকপাল বিল। মিডিয়া ও ক্রীড়া জগতের অনেক বিখ্যাত ব্যক্তির সমর্থন পেল এই বিল পাশের দাবীতে করা আন্দোলন। আমির খান, অমিতাভ বচ্চন, কপিল দেবের মতো ব্যক্তিরাও টুইট করে, খোলা চিঠি লিখে সমর্থন দিলেন এই আন্দোলনে। কংগ্রেস সরকার এবার আর গুরুত্ব না দিয়ে পারল না। দ্রুত পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করলো তারা।সরকার ঘোষণা দিল, মেনে নেওয়া হবে আন্না হাজারের সব দাবী। পাঁচ জন মন্ত্রী ও IAC-এর পাঁচ জনকে নিয়ে গঠিত হল যৌথ খসড়া কমিটি। পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে যারা তৈরি করবেন লোকপালের বিলের নতুন খসড়া। মন্ত্রিদের মধ্য থেকে কমিটিতে ছিলেনঃ প্রণব মুখার্জি (কমিটির চেয়ারম্যান), চিদম্বরম, বীরাপ্পা মইলি, কপিল সিব্বল ও সালমান খুরশিদ এবং IAC-এর পক্ষ থেকে ছিলেনঃ শান্তি ভূষণ (কমিটির কো-চেয়ারম্যান), তার পুত্র প্রশান্ত ভূষণ, আন্না হাজারে, সন্তোষ হেগড়ে ও অরবিন্দ কেজরিওয়াল।

এপ্রিলের মাঝ থেকে শুরু হয়ে দুই মাস যাবত চলল কমিটির বৈঠক। কিন্তু সাত দফা বৈঠকেও সমাধান এল না। ঐক্যমতে পৌঁছানো সম্ভব হল না। অবশ্য ঐক্যমতে পৌছা সম্ভবও ছিল না। কারণ ততদিনে এই দুর্নীতি বিরোধী আন্দোলনকে ঘিরে এক বিরাট ষড়যন্ত্রের ছক আঁকে কংগ্রেস বিরোধী রাজনৈতিক শিবির।

বিভিন্ন মত, পথ ও অঞ্চলের মানুষ নিয়ে IAC গঠিত হয়। তাদের সবাই যে এই ষড়যন্ত্র সম্পর্কে জানতেন, নিশ্চিতভাবেই সেটা দাবী করা যায় না। যারা জানতেন, তাদের অনেকেই হয়তো চুপ ছিলেন এই ভেবে যে, এ ষড়যন্ত্র ফাঁস হলে দুর্নীতি বিরোধী এই আন্দোলন ক্ষতিগ্রস্থ হবে, জন লোকপাল বিল পাস করার দাবীও আর তোলা যাবে না। তাহলে কারা যুক্ত ছিলেন বা স্বেচ্ছায় প্রশ্রয় দিয়েছেন এই ষড়যন্ত্রকে? অভিযোগের তীর আন্দোলনের প্রধান মুখ আন্না হাজারের দিকে। গান্ধিবাদি হিসেবে পরিচিত তিনি। অথচ গান্ধী মতাদর্শের বিরোধী বিজেপির সাথেই রয়েছে তার সখ্যতা। গুজরাটে দাঙ্গার কারণে মোদী যখন বিশ্বজুড়ে ছিলেন ধিকৃত, সেই সময়টাতেই তিনি মোদীর গুজরাট শাসনের প্রসংসা করেন।

এই দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনে যদিও প্রথমে দেখা যায়নি বাবা রামদেবকে (বিজেপি ঘনিষ্ঠ এক যোগ গুরু) কিন্তু একই সময়ে ভিন্ন মঞ্চে তিনি চালিয়ে গেছেন দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলন। এমনকি এক পর্যায়ে তারা উভয়ে একই মঞ্চে দাঁড়িয়েছেন।

এই আন্দোলনের পরিচিত আরো দুই মুখ কিরন বেদী ও শান্তি ভূষণ। কিরন বেদী সাবেক সেলেব্রেটি পুলিশ অফিসার। আন্দোলন শেষেই যিনি বিজেপিতে যোগ দেন এবং ২০১৫ সালে বিজেপির হয়ে দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী পদে লড়াই করেন। তেমনি শান্তি ভূষণ কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রীর ছিলেন জনতা দলের হয়ে। যেই জনতা দল থেকেই তৈরি হয়েছে আজকের ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)।

যদিও আন্দোলনটি ছিল অরাজনৈতিক। শুরুর সময়টাতে কোন রাজনৈতিক নেতাকেই মঞ্চে বসতে দেওয়া হয়নি। কিন্তু এই আন্দোলনের কথা তুলে কংগ্রেস সরকারের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রচারণা চালায় বিজেপি। যেন কংগ্রেস আর দুর্নীতি সমার্থক। এই আন্দোলনে তাদের ইমেজ এতটাই ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে যে, সহসা তারা আর ঘুরে দাঁড়াতে পারবে বলে মনে হয় না।

কংগ্রেস বুঝেছিল সবই কিন্তু এই আন্দোলনের বিরোধিতার মতো নৈতিক শক্তি তাদের ছিল না। কারণ, আন্দোলনের কয়েক মাস আগে প্রকাশিত হয়েছিল কয়েকজন মন্ত্রীর দুর্নীতির খবর। তাই প্রথম দিকে আন্দোলনের পক্ষে দাঁড়িয়ে কিছু দাবী মেনে পরিস্থিতি সামাল দিতে চায় তারা। কিন্তু আন্না যেন এক ব্ল্যাকমেইলার। কংগ্রেসকে বিপদে দেখে পূর্বের দাবীর সাথে এমন কিছু দাবীও যুক্ত করে তারা যেটা করার আইনি ক্ষমতা কংগ্রেসের ছিল না। আবার দাবী না মানায় তারা রাজনৈতিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছিল। তাই রাজনৈতিক পথেই আন্দোলন মোকাবেলার সিদ্ধান্ত নেয় কংগ্রেস। ফাঁস করা হয় শান্তি ভূষণের একটি ফোনালাপ, যেন প্রশ্ন ওঠে এই আন্দোলনকারীদের স্বচ্ছতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে। চালানো হয় দমন পীড়ন এবং সবশেষ বিজেপিসহ সব দলকে নিয়ে সংসদ থেকে দেওয়া হয় ঘোষণা। জনগণের নির্বাচিত সংসদ সদস্যরাই ঠিক করবেন, কী আইন পাশ হবে সংসদে?

অবশেষে ২০১১ এর শেষ সপ্তাহ, ডিসেম্বরের ২৭ তারিখে লোকসভায় পাস হল লোকপাল বিল। আন্নার বেশীরভাগ দাবীই অগ্রাহ্য হল এই বিলে। প্রতিবাদে আবারও অনশনে বসলেন আন্না। কিন্তু এবার আর অনশন কোন কাজে দিল না। লোক জড়ো হল না আগের মতো। মিডিয়াও নতুন হাইপ তৈরি করতে ব্যর্থ হয়ে সরে গেল। যেই অল্প ক’জন মানুষ দিয়ে শুরু হয়েছিল, সেই মানুষদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে গেল আন্দোলন। আন্নার বারবার অনশনের ডাক কিংবা IAC-এর শত প্রচেষ্টাতেও আর জোয়ার এল না সেই আন্দোলনে। হয়তো আন্দোলনটি হারিয়ে যেত বিস্মৃতির আড়ালে। কিন্তু যায়নি। আজো আন্দোলনটি প্রাসঙ্গিক হয়ে আছে একজন দেশপ্রেমিকের কারণে।

একজন নিখাদ দেশপ্রেমিক।

দ্যা মাফলার ম্যান।

(চলবে)

Facebook Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back To Top
error: Content is protected !!