হঠাৎ যদি আপনি আমার ক্লাসে ঢুকেন

আমার ক্লাস

হঠাৎ যদি আপনি আমার ক্লাসে ঢুকেন

হঠাৎ যদি আপনি আমার ক্লাসে ঢুকেন, মনে হবে, আমি যেন গল্প করছি।
বর্তমানের বা ইতিহাসের গল্প।
অথবা বর্ণনা করছি এমন কোন বস্তু বা দৃশ্যের কথা, ছাত্রদের নিকট যা খুবই পরিচিত।
তারপর যদি বসেন আরো কিছু সময়, দেখবেন, আপনি টেরও পাননি যে, কখন জটিল সব বিষয়গুলো পানির মতো সহজ হয়ে গেছে।
এটা আগে মাঝে মাঝে করতাম, এখন প্রায়ই করি। বিশেষকরে সেই ক্লাসগুলোতে যেখানে অনেক পড়া বুঝানোর আছে।
 
আগে আরেকটা ক্ষেত্রেও ভুল করতাম। প্রথমে পড়ার মূল কথা উল্লেখ করতাম। পরে বুঝানোতে যেতাম।
এখন তা করি না। কারণ, প্রথমেই যখন অপরিচিত বিষয় তাদের সামনে উল্লেখ করি, তারা ভয় পেয়ে যায়। তার বদলে যখন প্রথমে পরিচিত কোন দৃশ্যের কথা উল্লেখ করি, তারাই সহজেই সেটা অনুধাবন করতে পারে এবং পরবর্তী পড়াগুলোও তারা বুঝে নিতে সক্ষম হয়।
 
এই যেমন, সেদিন মিজানের (ষষ্ঠ শ্রেণীর) ছাত্রদের নিয়ে বসলাম। উদ্দেশ্য তারকীবের বিষয়গুলো স্পষ্ট করা। একেবারে শুরু থেকে এবং ধারাবাহিকভাবে।
প্রথমেই আমি তারকীবের সংজ্ঞা ও উদাহরণ দিতে পারতাম। উদাহরণে মুবতাদা-খবর বা ফেয়েল-ফায়েলের কথা আসতো। যেটা চিন্তায় আনতেই তাদের অনেক সময় কেটে যেত।
আমি সে পথে গেলাম না।
 
ছাত্রদের বললাম, “সাইকেল চিনো?”
সবাই চিনে। সবার মুখে হাসি ফুটে ওঠলো। কারণ, এই বয়সী ছেলেদের কাছে সাইকেল পরিচিত ও প্রিয় একটি জিনিস। অন্তত এই বয়সে আমার অত্যন্ত প্রিয় জিনিস ছিল। (যদিও আমার নিজের করে পাওয়ার সেই ইচ্ছা কখনো পূর্ণ হয়নি। যাক সে কথা।)
ছাত্রদের বললাম, “আচ্ছা বলতো, সাইকেলে কয়টা অংশ আছে?”
ছাত্ররা বলতে লাগলো, “চাকা, চেইন, প্যাডেল, হাতল, বেল……।”
-মানে তোমরা সাইকেলের তারকীব পারো।
ছাত্ররা অবাক। বুঝেনি।
– এই যে তোমরা একটি সাইকেলের বিভিন্ন অংশের বর্ণনা দিলে, সেটিই হচ্ছে সাইকেলের তারকীব করা।
কারণ, তারকীব করা বলতে একটি বাক্যের প্রতিটি শব্দের অবস্থান বর্ণনা করাকেই বুঝানো হয়। মানে ধরো, একটি বাক্য তোমরা পড়লা, তারপর বললা যে, এই শব্দটা বা শব্দগুলো বাক্যের অমুক অংশ, ঐ শব্দ বা শব্দগুলো বাক্যের তমুক অংশ, সেটাই হবে তারকীব করা। অমুক বা তমুক অংশ তো বলে না। কিছু নির্দিষ্ট নাম বলে, যেটা আমরা কিছুক্ষণ পরেই জানব ইনশাআল্লাহ্‌।
 
– আচ্ছা, বলতো, যে সাইকেল চালায়, সে কি সাইকেলের চাকা, প্যাডেল, হাতল, বেল ইত্যাদি অংশ চিনে?
ছাত্ররা মাথা নাড়িয়ে সায় দিল।
– তাহলে আরবী ভাষা শিখতে চায়, তাকেও তারকীব জানতে হবে, বুঝতে হবে। যে বাক্যের প্রতিটি শব্দের পরিচয় জানবে, তার জন্য আরবী বাক্যের তরজমা করা ও হরকত বসানোতে কোন সমস্যা হবে না ইনশাআল্লাহ্‌।
তারকীবের পরিচয় ও প্রয়োজনীয়তা বুঝানো শেষ। ছাত্রদের বললাম, ‘সব ভালোভাবে বুঝেছো?’
সবাই এক সাথে ‘জি’ বলে চিৎকার দিল।
-মনে থাকবে?
এবার কিছুটা দ্বিধান্বিত।
-মনে না থাকলে ‘সাইকেলের’ কথা মাথায় রেখো।
 
তারপর প্রশ্ন করলাম, “তারকীব মানে কী?”
“সাইকেল”- কে যেন বলে ওঠল।
সবাই যেন হেঁসে ওঠল তার কথায়।
এভাবে সবসময় হাসিখুশি রাখার চেষ্টা পুরো ক্লাসটাকে।
 
এই তো সেদিন তাফসীরে বায়যাবীর দরসে। জটিল সব সব পড়া সাধ্যমতো সহজ ভাষায় বুঝানোর চেষ্টা করছি। তিন জন করে ছাত্র এক বেঞ্চে বসে। দেখলাম, পিছনের এক বেঞ্চের দুই সাইডের দুই জন ছাত্র ঝিমাচ্ছে।
‘এই!’
আমার ডাক শুনে তারা লাফ দিয়ে ওঠল।
হঠাৎ তাদের লাফ দেওয়া দেখে বললাম, “দুই ধারে দুই রুই-কাতলা ভেসে ওঠেছে।”
পুরো ক্লাস যেন হেঁসে দিল। সজীবতা ফিরে আসল আমার পরবর্তী পাঠদানে।
 
শিক্ষক হওয়ার আগেই নিয়ত করেছিলাম, যথাসম্ভব ছাত্রদের শাস্তি দিব না।
আচ্ছা, শাস্তি দেওয়া হয় কেন?
বেশীরভাগ সময়ই পড়া না শেখা বা না পারার জন্য।
আচ্ছা, যারা পড়া পারে না, তারা কেন পারে না?
আমার যেটা বুঝে আসে, সেটা হল অনাগ্রহ এবং পড়া না বুঝাই এখানে মূল কারণ।
তাই ক্লাসটাকে হাসিখুশি রাখার চেষ্টা করি। যেন তারা সহজেই পড়া বুঝে। প্রায় এমন কথা বলি, যেই কথায় তারা পড়ার প্রতি আগ্রহ পায়।
আলহামদুলিল্লাহ, আমার যা অভিজ্ঞতা। শাস্তি দেওয়া ছাড়াই প্রায় নব্বই ভাগ ছাত্র খুব ভালোভাবে পড়া শিখে।
 
শিক্ষকতার ছয় বৎসর চলছে। রাজনীতি জড়িয়ে পড়ার কারণে একটা সময় হয়ত আমাকে শিক্ষকতা ছেড়ে দিতে হবে। কিন্তু আমার রাজনীতির পিছনেও তো শিক্ষা ব্যবস্থা একটি বড় কারণ। যেটা বারবারই বলি, শিক্ষা ছিল একটি দুর্বল বাচ্চার হাতের লাঠির মতো, যে লাঠিতে ভর দিয়ে সে দূরের পথে এগিয়ে যাবে। কিন্তু আমরা শিক্ষাব্যবস্থাটাকে কী বানিয়ে রেখেছি? একটি বাচ্চার পিঠে বইয়ের পর বই চাপিয়ে দিয়েছি, যার নিচে চাপা পড়ে তার মেরুদণ্ড ভেঙ্গে যায়, মাথাটা মাটির নিচে ঢুকে যায়, পড়াশুনাটা তার কাছে আর আনন্দময় থাকে না।
 
কিন্তু আমি একজন সামান্য শিক্ষক এই অবস্থার পরিবর্তন কিভাবে করব?
সেই জন্যই আমি রাজনীতি করতে চাই। যেন একটা আওয়াজ ওঠানো যায়। যার মাধ্যমে শিক্ষাব্যবস্থার এই ত্রুটি ও চাপ দূর হবে। সহজ ও আনন্দময় হবে শিক্ষার পরিবেশ।
 
তবে সেই পথ অনেক দূরের। কবে না কবে পূরণ হবে সেই স্বপ্ন তা জানি না। কিন্তু আমার যেটুকু সামর্থ্য আছে, যেটুকু কাজের ক্ষেত্র আছে, সেখানেই নাহয় আমি চেষ্টা করে যাই। একজনের জীবনে একটা সাবজেক্টও যদি আমি সহজ করে তুলতে পারি, সেটাও তো আমার সফলতা, আমার আনন্দ।

Facebook Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back To Top
error: Content is protected !!