হাতটি ধরো

হাতটি ধরো

হাতটি ধরো

১
-কত টাকা দিতে হবে ভাই?
-'টাকার কথা আসছে কেন?' ভাবনার জগতে হারিয়ে গেলাম আমি।
আমি তো শুধু হাতটা ধরতে চেয়েছিলাম আমার সীমিত সামর্থ্য নিয়ে।

২
শৈশবে খুব অভাববোধ করেছি একটি হাতের। যেই হাত কেউ আমার কাঁধে রাখবে। বলবে, 'ভয় পেওনা। পাশে আছি।' আমার হাতটি ধরে সামনের দিকে আমায় এগিয়ে দিবে। কিন্তু পাইনি। সেই না পাওয়ার ব্যাথা হয়ত আমি জীবনেও ভুলতে পারব না।

৩
আম্মু বলে, ছোটকাল থেকেই নাকি আমার জানার আগ্রহ খুব। নাস্তার টাকা যা পেতাম, বেশীরভাগ টাকা দিয়েই বই কিনতাম পুরানা পল্টনের পুরাতন বইয়ের দোকান থেকে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের সকল বিষয়ে কিছুটা ধারণা রাখার ইচ্ছে ছিল নিজের মাঝে। আর ইচ্ছে ছিল ইংরেজি ভাষা কিছুটা শেখা। কারণ, সবচেয়ে বেশী জ্ঞান এই ভাষাতেই লিপিবদ্ধ আছে।

৪
ইংরেজরা যখন এদেশে তাদের শিক্ষাব্যবস্থার প্রচলন করে, তখন উলামায়ে কেরাম এর বিরোধিতা করেছিলেন। কারণ তারা প্রত্যক্ষ্য করছিলেন যে, ইংরেজদের প্রণীত শিক্ষাব্যবস্থায় মুসলমান ঘরের সন্তানেরা বস্তুবাদী হয়ে যাচ্ছে। নামে আব্দুল্লাহ এরকম অনেকেই হয়ে যাচ্ছিল আবদে ইংরেজ বা ইংরেজদের গোলাম। সেই সময় অনেক আলেমই ইংরেজদের প্রণীত শিক্ষাব্যবস্থাকে এবং ইংরেজি ভাষা শেখাকে 'হারাম' বলে ঘোষণা দেন। যাদের মধ্যে একজন ছিলেন আব্বুর দাদা। উজানীর কারী ইবরাহীম নামে যিনি অনেকের কাছে পরিচিত। (রহিমাহুল্লাহ)

৫
আব্বু হলেন এমন মানুষ যিনি নিজের পিতা ও দাদার পরিচয় নিয়ে খুব গর্ব করেন। তাদের কাজগুলোকেই নিজের কাজ বানিয়ে নিয়েছেন এবং তাদের মতামতকেও ধারণ করেছেন নিজের মাঝে। সেই হিসেবে আব্বুর মুখেও অনেকবার শুনেছি, 'ইংরেজি ভাষা শেখা হারাম।' কিন্তু আমি তো এই বিষয়ে প্রচুর পড়েছি। জানি, সেই সময় আর এই সময়ে বহুত তফাত। কিন্তু কে বুঝাবে আব্বুকে?
একদিন আব্বু কোথাও যাচ্ছিলেন। একই গাড়িতে ছিলেন বেফাকের সাবেক মহাসচিব আব্দুল জাব্বার জাহানাবাদী রহিমাহুল্লাহ। আব্বুর অস্থিরতা দেখে তিনি প্রশ্ন করেছিলেন, কী হয়েছে? আব্বুও খুলে বললেন সব। তারপর তিনি আব্বুকে বুঝিয়েছিলেন, বর্তমান সময়ে ইংরেজিসহ আরও অনেক বিষয় জানার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। সম্ভবত খুব ভালোভাবেই বুঝাতে পেরেছিলেন। কারণ, এরপর আব্বু কখনোই আমার পড়াশুনার ক্ষেত্রে বাঁধা দেননি। তবে উৎসাহও দেননি কখনো এবং এটাও জানি যে, আমি মাদরাসার জগত নিয়ে পড়ে থাকলেই আব্বু অনেক খুশি হন।

৬
আব্বু মেনে নেওয়ার আগেই আমি নিজে নিজে ইংরেজি শেখার চেষ্টা করেছি। কিন্তু অভাববোধ করেছি একটি হাতের, যে হাত আমাকে ওঠে দাঁড়াতে সাহায্য করবে। ইংরেজি ভাষা শেখার পথে এগিয়ে দিবে।
আমি নিজে নিজেই যতদূর পেরেছি চেষ্টা করেছি। যার কাছে একটা লাইন শেখা যাবে, তার কাছেই ছুটে গিয়েছি। তবে আমার মাদরাসার পড়াশুনা আমি তখনো শতভাগ ঠিক রেখেছিলাম। আরবিটা খুব ভালোভাবে শিখেছিলাম। আর এ ফলে এমন এক রাস্তা আমার জন্য খুলে যায় যা আমার ইংরেজি শেখাটাকে খুব সহজ করে দিয়েছিল। আমি দেখলাম, আরবীর অনেক নিয়ম আমি ইংরেজিতে ব্যবহার করতে পারছি। আরবীর সাহায্যে খুব সহজে বুঝতে পেরেছি ইংরেজি ভাষার প্রায় সব নিয়ম।

৭
ইংরেজির যেই বিষয়গুলো আরবী দিয়ে বুঝানো যায়, প্রায় সবই আমার আয়ত্নে এসে গেল। কিন্তু আমি যদি মারা যাই বা অন্য কোন কাজে ব্যস্ত হয়ে যাই, তাহলে অনেক ভেবে-চিন্তে বের করা সেই নিয়মগুলো হারিয়ে যাবে? এই প্রশ্ন কুরে কুরে খাচ্ছিল আমার ভিতরটাকে।
তারপরেই অন্য একটা প্রশ্ন আমার ভিতরের সেই অশান্তি দূর দিয়েছিল।
আচ্ছা, আমি যেরকম একটি হাত আমাকে পথ দেখানোর জন্য খুঁজছিলাম, এরকম কেউ কি কাউকে খুঁজে না?
খুঁজলেও অফলাইনে এরকম কাউকে পাওয়া আমার জন্য সহজ না। তাই অনলাইনের সাহায্য নিতে হল আমাকে। পেলামও অনেককে যারা ইংরেজি ভাষা শিখতে চায়। তিন বছর আগে ঠিক এই দিনেই একজন আমাকে বলেছিল, ভাই, গ্রুপে যুক্ত হতে হলে কত টাকা দিতে হবে?
আমি বললাম, টাকা না ভাই। শুধু আপনাদের শেখাটা দেখতে চাই। কিন্তু হায়, টাকা নেইনি বলেই হয়ত অনেকের কাছে গুরুত্ব ছিল না। আর অনেকে শুধু শিখতে চায়, কিন্তু কষ্ট স্বীকারে আগ্রহী না। শেষ পর্যন্ত মাত্র চার জন ছিলেন। সেই চারজনকে নিয়েই অনেক পথই গিয়েছিলাম। এক পর্যায়ে দু'জন ব্যস্ততার কথা জানালেন, তখন আমার আগ্রহটাই মরে গেল।
তারপরেও এখনো মনে চায়, পথের দ্বারে হাত বাড়িয়ে বসে থাকি।
আমি যেটুকু জানি, সেটুকু শেখার পথে কেউ যদি অগ্রসর হতে চায়। তাকে বলি,
"হাতটি ধরো। দেখি, কতদূর পথ তোমাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি।"

Facebook Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back To Top
error: Content is protected !!